আদিবাসী সাঁওতালদের জীবনচিত্র
সরদার জাহিদুল কবীর: সাঁওতাল পূর্বভারত ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আদিবাসী নৃগোষ্ঠীগুলির একটি । এরা নিজেদেরকে মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের প্রত্যাখ্যাত-ভাবশিষ্য একলব্যের বংশধর ব’লে বিশ্বাস করে। তাই তীরচালনাকালে এখনও এরা নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুল ব্যবহার করে না। কারণ তাদের আদিপুরুষ একলব্যকে গুরুদক্ষিণাস্বরূপ নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দান করেছিলেন । এরা সান্তাল, সান্তালি, হোর, হর, সাঙ্তাল, সান্দাল, সন্থাল, সান্থাল, সান্তালি, সাতার প্রভৃতি নামেও পরিচিত।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে যে, আদি মানব ও মানবী পিলচু হড়ম ও পিলচু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান থেকেই তাদের উদ্ভব । এজন্যই সাঁওতালরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত । সাঁওতালী ভাষায় এ গোত্র গুলো ‘পারিস‘ নামে অভিহিত । এগুলো হলো হাঁসদা, সরেন, টুডু, কিসকু, মুরমু, মারুদি এবং বাস্কে।
এই সাতটি গোত্র ছাড়াও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে । সাঁওতালদের মধ্যে টোটেম বিশ্বাস প্রচলিত আছে ।
এই সাতটি গোত্র ছাড়াও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে । সাঁওতালদের মধ্যে টোটেম বিশ্বাস প্রচলিত আছে ।
তিটি গোত্র তাদের পূর্বপুরুষ কিংবা গাছপালা, জীবজন্তু ও পশুপাখী ইত্যাদি নামে পরিচিত । হাঁসদাক গোত্রের লোকের বিশ্বাস তাদের উদ্ভব ঘটেছে হাঁস থেকে । তাই হাঁসদাক গোত্রের হাঁস ভক্ষণ নিষিদ্ধ । আবার সোরেন গোত্রের উৎপত্তি হরিণ থেকে তাই তাদের হরিণের মাংস খাওয়া নিষেধ ।
ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্য অনেক নৃগোষ্ঠীর মত মঙ্গোলীয় গোত্রের নয় ।
ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্য অনেক নৃগোষ্ঠীর মত মঙ্গোলীয় গোত্রের নয় ।
এরা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে, যে ভাষাটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত । এদের মধ্যম গড়নের শরীর , ত্বকের গাঢ় রঙ , চ্যাপ্টা নাক , পুরু ঠোঁট এবং কোঁকড়ানো চুল অস্ট্রেশীয় নৃতাত্বিক উৎস নির্দেশ করে। এই গোষ্ঠির মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল দ্রাবিড়দেরও আগে অস্ট্রেলিয়া এবং সন্নিহিত প্রশান্ত মহাসাগরীয়দ্বীপমালা থেকে । ধারণা করা হয় সুঁতার(Soontar) কথাটি থেকে সাঁওতাল শব্দের উদ্ভব। সুঁতার বাঙালিদের দেয়া খেতাব ।
সাঁওতালরা বাংলাদেশের দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে বাস করে। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট , ফুলবাড়ি, চিরিরবন্দর , কাহারোল এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাঁওতালরা অধিক সংখ্যায় বাস করে। রাজশাহী এবং বগুড়া অঞ্চলে কিছু সংখ্যক সাঁওতাল আছে।
এদের ঘরগুলো ছোট এবং মাটির তৈরি। ঘরে সাধারণত কোনো জানালা থাকে না । সাঁওতালরা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালো বাসে। সাঁওতাল পুরুষরা আগে সাদা থান কাপড়ের ধুতি পরতেন। বর্তমানে লুঙ্গি, ধুতি, গেঞ্জি, গামছা ব্যবহার করে। নারীরা ‘ফতা‘ নামের দুই খন্ডের কাপড় প’রে থাকে। বর্তমানে শাড়িও ব্যবহার করতে দেখা যায় । পুরুষরা হাতে উল্কির ছাপ দেয় । মেয়েরা রূপার তৈরি গহনা যেমন- বালা, ঝুমকা, আংটি, মল, হাঁসুলি ইত্যাদি ব্যবহার করে এবং খোঁপায় ফুল গুঁজতে ভালোবাসে । অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী সাঁওতালি সমাজে যে বিয়ে হয় তাকে সাঁওতালি ভাষায় ‘ডাঙুয়াবাপলা‘ বলে। আগের দিনে মৃতদেহ দাহ করার নিয়ম ছিল । বর্তমানে অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সকল এলাকায় সাঁওতালরা মরদেহের কবর দেয়।
ভাত সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য। মাছ, কাঁকড়া, শুকর, মোরগ, মুরগি, বন জঙ্গলের পশু, পাখি, খরগোশ, গুইসাপ, ইঁদুর বেঁজির মাংস এদের খুবই প্রিয় খাবার।আদিকাল থেকেই কৃষিকে এরা প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে । নারী পুরুষ সবাই জমিতে কাজ করে । পুরুষেরা হাল চাষ এবং নারীরা বীজ বোনা ও ফসল তোলার কাজ করে। সাঁওতালরা কৃষিকাজের যন্তপাতি নিজেরা তৈরি করে। শিকার করার ব্যাপারে এদের উৎসাহ খুব বেশি।
সাঁওতাল সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তিতে পুত্রদের অধিকার সমান, কিন্তু মেয়েদের কোন অধিকার নেই। তবে পিতা ইচ্ছা করলে মেয়েকে কিছু দিয়ে যেতে পারেন। তবে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে পিতা প্রত্যেক মেয়েকে একটি করে গাভী প্রদান করে। পুত্রহীন ব্যক্তির যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা তার সহোদর ভাইয়েরা পেয়ে থাকে।
সাঁওতাল সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তিতে পুত্রদের অধিকার সমান, কিন্তু মেয়েদের কোন অধিকার নেই। তবে পিতা ইচ্ছা করলে মেয়েকে কিছু দিয়ে যেতে পারেন। তবে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে পিতা প্রত্যেক মেয়েকে একটি করে গাভী প্রদান করে। পুত্রহীন ব্যক্তির যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা তার সহোদর ভাইয়েরা পেয়ে থাকে।
সাঁওতাল সমাজে বহিঃগোত্র বিবাহ প্রচলিত। এমনকি উপগোত্রের মধ্যেও বিবাহ হয় না। তাদের সমাজে ছয় প্রকার বিবাহ রীতের প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তিন ধরনের বিবাহের প্রচলন দেখা যায়। যথা আসলি, রাজারাজি, হুর কাটারা বা ইতুর বিবাহ। সাধারণত ছেলের বয়স ১৯ ও মেয়ের বয়স ১৫-১৬ হলে বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়।
সাওঁতালদের পালন করা রীতিনীতি হিন্দুধর্মেরই অংশ।তামিলদের মতো শুধুমাত্র ভাষার বিভিন্নতা আছে।সাওঁতালী ভাষায় দেবতাকে ‘বোংগা‘ বলে। এদের প্রধান দেবতা হচ্ছে সূর্যদেব। এরা নিজস্ব সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলে। এদের জীবন যাপন সহজ ও সরল । বর্তমানে সাঁওতালিদেরও ওপর বাঙালি সমাজের প্রভাব পড়েছে । এদের অনেকে শিক্ষালাভ ক’রে আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে । ফলে এদের আচার আচরণে পরিবর্তন আসছে ।এরা ঢোল, দোতারা, বাঁশি, মেগো প্রভৃতি বাদ্যযন্ত তৈরি করে ও বাজায় । ঘরবাড়ির দেয়ালে ছবি আঁকে।
৩০ জুন সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস । আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক এবং শোষক জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের গণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল এই দিনে । সেদিন ইংরেজ শাসকদের কঠিন বুকে কাপন ধরিয়ে দিয়েছিল তারা । ক্রমাগত শোষন, বঞ্চনা , নির্যাতন, দাসত্ব এবং নারীদের অবমাননা যখন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দেয় তখন শান্তিপ্রিয় সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভের দাবানল জ্বলে উঠে এবং প্রতিবাদের ঝড় । আদিবাসিদের অধিকার প্রতিষ্টায় সেই রক্তঝরা সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসটি প্রতিবছর বিশেষ মর্যাদায় প্রতিপালিত হয়ে থাকে ।
0 Comments