ইরাবতী তটিনী:
পৃথিবীর সহজ-সরল এবং সাহসী মানব সম্প্রদায়ের একটি হলো সাঁওতাল। সাঁওতালদের আরেক নাম মান্দি। তাদের আরো অনেক নাম আছে। যেমন- সান্তাল, হোর, সান্দাল, সন্থাল, সাতার। পৃথিবীর প্রতিটি সমৃদ্ধ জাতি-সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে- তারাই সৃষ্টিতত্ত্বের আদি মানব মানবী থেকে সৃষ্টি হয়েছ। সাঁওতালদেরও এরকমই বিশ্বাস! তাদের বিশ্বাস হলো, আদি মানব ও মানবী পিলচু হড়ম ও পিলচু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান থেকে তাদের উদ্ভব। এজন্যেই সাঁওতালরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত। সাঁওতালী ভাষায় গোত্রগুলোকে বলে ‘পারিস’। গোত্রগুলো হলো; হাঁসদাক, সোরেন, টুডু বা হেমবরোম, কিসকু, মুরমু, মারুদি ও বাস্কে। তবে সাতটি গোত্র ছাড়াও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে। আমাদের বৃহত্তর সমাজে নারীর যে চিত্র আমরা পাই, আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের নারীরাও সেই একইরকম বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। যারা প্রজন্ম-প্রজন্মান্তর ধরে কর্মঠ, শক্তিশালী, উদ্দাম; সেই সাঁওতাল নারীরা আজও কত অসহায়! এই অসহায় সাঁওতাল নারীদের সামাজিক পারিবারিক অবস্থা ও অবস্থান নিয়েই এই নিবন্ধ। আমাদের দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তুলনায় আদিবাসী সাঁওতালরা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ ও দুর্বল। সাঁওতাল নারীরা আরো বেশি দুর্বল। তাদের ঐতিহ্যগত আইন এবং প্রথায়ও নারীকে দুর্বল করে রাখারই বিধান কার্যকর রয়েছে। সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, তারা সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করে এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। আদিবাসী সমাজব্যবস্থাকে ‘সমঅধিকারের সমাজব্যবস্থা’ হিসেবেও চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যদিয়ে আসলে আদিবাসী নারীর দুরবস্থাকে আড়াল করে ফেলা হয়। সাঁওতালদের মধ্যে সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি নেই। বাবা-মায়ের সম্পদের উত্তরাধিকার হয় ছেলেরা। মেয়েরা কোনো সম্পদই পায় না। কারো পুত্রসন্তান না-থাকলেই কেবল মেয়েরা উত্তরাধিকারের সম্পত্তির মালিকানা পায়। কোনো মায়ের যদি সম্পদ থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্য মেয়েরা ওই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। তবে এমন ঘটনা আদিবাসী সমাজে একেবারেই কম। সাঁওতাল নারীদের নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করার আগে প্রথমেই বৃহত্তর সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আমরা আলোকপাত করব। আলোচনা করবো আমাদের বৃহত্তর সমাজ বা মূলধারার নারীদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে। আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক বা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজের সম্পদ, উৎপাদনের মাধ্যম, নারীর শ্রম ইত্যাদির ওপর পুরুষের কর্তৃত্বের বৈধতা স্বীকার করে। এ ধরনের সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক অধস্তনতা ও কর্তৃত্ব, নির্ভরশীলতা ও নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে নির্ণীত হয়। সমাজপতিরা যেহেতু পুরুষ, তাই সমাজের পদে পদে নিত্যনতুন ব্যবস্থাপনায় তারা নারীকে শৃঙ্খলিত করে রাখে। পিতৃতান্ত্রিক এ সমাজে শুধু পুরুষ নয়, সামাজিকায়ন প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে নারীকে অধস্তন ও পুরুষকে প্রাধান্য বিস্তারকারী হিসেবে দেখতে চায়। পুরুষ তার সংসার ও পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূরণে তৈরি করেছে বিভিন্ন মূল্যবোধ। মূল্যবোধ তৈরিতে এই প্রয়োজন পূরণই সূচক হিসেবে কাজ করে। নারীশিশুর জন্য খেলনা থেকে শুরু করে তার পোশাক, শিক্ষার বিষয়বস্তু, চলাফেরার ধরন, কথা বলার ঢঙ, পেশা; সবকিছু সম্পর্কেই মূল্যবোধ তৈরি করা হয়- এই প্রয়োজন পূরণকে সামনে রেখে। পিতৃতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে মূল্যবোধ তৈরি করা হয়, সেখানে নারী হচ্ছে নিকৃষ্ট; এবং পুরুষ-বিনা নারীর গতি নেই। তাই জন্মমাত্রই নিকৃষ্ট ভেবে মেয়েশিশুকে ছুঁড়ে দেয়া হয় বৈষম্যমূলক অবস্থানে। আবার এই বৈষম্যকে পাকাপোক্ত করতে- নারী যাতে তা মেনে নেয়; সেজন্য বৈষম্যের অনুকূলে তৈরি করা হয় মূল্যবোধ। নারী যাতে কোনোমতেই স্বাবলম্বী হতে না পারে; সেজন্য নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয় না এবং তাদের পছন্দমতো পেশাও বেছে নিতে দেয়া হয় না। সেইসঙ্গে নারীরা যাতে সম্পদশালী না হতে পারে সেজন্য যতটুকু সম্পত্তি তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পায় ততটুকুও গ্রহণ করা অনুচিত বলে প্রচার করা হয়। নারীর স্বাবলম্বন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো মূল্যবোধ তৈরি করা হয় না। বিরাজমান মূল্যবোধ তাই নারীকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। ফলে মূল্যবোধের দুষ্টচক্রে পাক খেয়ে নারী আরো অধিকার, মর্যাদা, সম্পদ ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। নারীকে আড়াল করার জন্য পুরুষের একটি যৌনআগ্রাসী ভাষাও রয়েছে। এমনকি নারী যে সাংস্কৃতিক কাজে ব্যাপৃত হয়, তার মূল উদ্দেশ্য যা-ই হোক, পুরুষের সন্তুষ্টিই তার পরিণতি। এভাবে অসমতার ভিত্তিতে নিরূপিত সম্পর্কের কারণে নারী হয় বঞ্চিত, নিগৃহীত ও শোষিত। সমাজ নারীর চরিত্রের কিছু ভাবমূর্তি আরোপ করে তাকে নির্ভরশীল, পরমুখাপেক্ষী, সংসারে ক্লান্তিহীন শ্রমদানকারী, ত্যাগ-তিতিক্ষায় পরিপূর্ণ চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করে। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে, উৎপাদনশীলতায় নারীর ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। এভাবে ব্যয়িত শ্রম সরাসরি টাকায় রূপান্তরিত হয় না বলেই সাধারণত নারীর শ্রমদানের স্বীকৃতি আসে না। সন্তান জন্মদান ও লালনপালনের মধ্যদিয়ে নারী যে ভূমিকা পালন করে; তারও যথাযথ স্বীকৃতি নেই। বরং, তার এই অবদান শক্তিতে রূপান্তরিত না হয়ে দুর্বলতায় পর্যবসিত হয়। এতে করে নারীরা সম্মান নিয়ে কেউ সামাজিক-রাজনৈতিক ময়দানে অবাধে বিচরণ করতে পারে না। দারিদ্র্য ও পরিবেশগত চাপে নারী আজকাল গৃহস্থালি গণ্ডির বাইরে জীবিকার অন্বেষণে বের হচ্ছেন। সনাতন কর্মক্ষেত্রের বাইরে বিভিন্নক্ষেত্রে, শহরে নির্মাণশিল্পে বা গ্রামের ক্ষেতখামারে দিনমজুর হিসেবে নারী উপার্জন করে পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছেন। রপ্তানি শিল্পে ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। সর্বক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ সংজ্ঞাগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতার কারণে জাতীয় পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হয় না বলে উন্নয়ন কৌশল ও লক্ষ্য নির্ণয়ে নারীর সমস্যা চিহ্নিত হয় না এবং অর্থনৈতিক অবদান পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে না। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আইন-নীতি, প্রথা-পদ্ধতি সবকিছুই পুরুষের অনুকূলে। এই ব্যবস্থায় নারী পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পরিবারে প্রচলিত নিয়মনীতির ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরাচরিত প্রথা ও আচরণ হিসেবে অনুসরণ করা হয়। মেয়েশিশুকে ছেলেশিশুর তুলনায় কম মূল্যবান মনে করা, তার ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক বিধিনিষেধ আরোপ করা, নারীর কাজকে অবহেলা করা, ঘরেবাইরে সিদ্ধান্তগ্রহণে পুরুষকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেয়া, নারীর প্রতি সবরকম অবহেলা ও নির্যাতনকে প্রাত্যহিক অভ্যস্ততায় সহনীয় করে তোলা, এমনকি যত্রতত্র নারীর যৌন হয়রানির শিকারে পরিণত হওয়া আজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে সাঁওতাল নারীরা বাইরে কাজ করতে গেলে বিভিন্নভাবে বাঙালিদের দ্বারা নির্যাতিত হয়, হচ্ছে। বিশেষত তারা কাজের যোগানদাতা বাঙালি মালিক দ্বারা নির্যাতিত হয়। অনেক সময় মালিকরা খারাপ কথা বলে, কম মজুরি দেয়। তাদের ভাষার জন্য টিটকারি করে। বাইরে কাজ করতে গেলে মেয়েরা সাধারণত যৌন হয়রানির শিকার হয় বেশি। নিজ সম্প্রদায়ের সাঁওতাল পুরুষ দ্বারাও নারীরা মাঝে মাঝে নির্যাতনের শিকার হয়, তবে তা খুব কম। যদি তেমন কোনো যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে, তবে সামাজিকভাবে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। নির্যাতিতা নারীদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নেতিবাচক। তাদের আলাদা চোখে দেখা হয়। নির্যাতিত নারীকে সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুদ্ধ হতে হয়। নির্যাতিতার পরিবারকে গ্রামপ্রধানদের খাওয়াতে হয়। নির্যাতিত নারীরা সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। তাদের ভালো বিয়ে হয় না। ভালো ছেলেরা নির্যাতিত হওয়াকে খুঁত মনে করে, সমাজ নির্যাতিতদের ‘চরিত্রহীন’ বলে আখ্যা দেয়। তার উপর এসব নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে আদিবাসীদের বিপদে পড়তে হয়। এজন্য নির্যাতনের ঘটনার বড়বেশি প্রতিবাদ তারা করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো প্রকাশ পায় না। এসব ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিশেষ স্পর্শকাতরতা রয়েছে। এসব বিষয় জানাজানি হওয়ার চেয়ে গোপন রাখাটাকেই সবাই বেশি নিরাপদ মনে করে। বেশিরভাগ আদিবাসী গোষ্ঠীতেই নারীর কোনো উত্তরাধিকার নেই। অনিশ্চিত উত্তরাধিকার নারীর বঞ্চনাকেই কেবল জিইয়ে রাখে না; একধরনের নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করে। ভূমির ওপর আগ্রাসন ও সাঁওতাল নারীর প্রান্তিকীকরণ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত কায়েমি স্বার্থের পক্ষাবলম্বনকারী রাষ্ট্র নানা অজুহাতে বারবার ল-ভ- করেছে সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, তাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। উন্নয়নের নামে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি, ইকোপার্ক নির্মাণ, অগ্রহণযোগ্য কয়লাখনি খনন প্রক্রিয়া, আর অধিপতি জনগোষ্ঠীর জমি দখলের দুর্দমনীয় লোভ ছিনিয়ে নিয়েছে সাঁওতালদের ভূমি, ভাষা, এমনকি সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য। উচ্ছেদ হয়েছে হাজার হাজার সাঁওতাল পরিবার। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নিপীড়ন, উচ্ছেদ আতঙ্ক? চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে আদিবাসী সাঁওতাল নারীর মানবাধিকার। আবার সাঁওতালদের সমাজে মেয়েরা ব্যাপক মাত্রায় বাল্যবিয়েরও শিকার হয়। অভিভাবকরা মনে করে, মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে সমাজে যোগ্যপাত্র পাওয়া যাবে না। যৌতুক বেশি লাগবে, এই অবস্থা সাঁওতালসহ যেসব সম্প্রদায় শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। তবে অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের অজ্ঞতার কারণেও মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়। পরিবারের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত আদিবাসী নারীদের কাঁধেই চাপে। পুরুষ নানাভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। কিন্তু ক্ষুধার্ত সন্তানের সামনে একমুঠো খাবার তুলে দেবার দায়িত্ব নারী আমৃত্যু পালন করে থাকে। কাজেই সংসারের অভাব-অভিযোগ, ঝক্কি-ঝামেলা নারীদেরই পোহাতে হয়। চরম বিপদের দিনেও তাকে পরিবারের সদস্যদের অন্নসংস্থানের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। সাঁওতাল পরিবারগুলোতে সারাবছর অভাব থাকায় সংসারের অভাব মেটানোর জন্য তারা কখনো কখনো এনজিওর ঋণ গ্রহণ করে থাকে। সাঁওতাল নারীদের অনেকেই বর্তমানে মহাজনি এবং এনজিওদের ঋণের জালে জর্জরিত। এনজিওগুলোর আদিবাসীদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে পৃথক পলিসি নেই। এদিকে আদিবাসীরা গতানুগতিক ঋণ নিয়ে এই ঋণের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ঋণের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না-পারায় এই ঋণ তারা জীবনে কখনোই পুরোপুরি পরিশোধ করতে পারে না। সুদের দুষ্টচক্রে পড়ে তাদের জীবন বাঁধা পড়ে যায়। সৃষ্টি হয় স্থায়ী অশান্তি। সাঁওতাল সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীকে দেখা হয় দুর্বল হিসেবে। এই ‘দুর্বল’দের ওপরই সব কাজের বোঝা চাপিয়ে পুরুষরা নারীর ওপর অমানবিক জুলুম চালিয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য থেকে সৃষ্ট এই শ্রমবৈষম্য আদিবাসী নারীকে চরম নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য পুরুষরা এটাকে ‘নির্যাতন’ হিসেবে মানতে নারাজ। নারীরাও এটাকে নিয়ম এবং ‘নিয়তি’ মনে করে। নির্যাতন হিসেবে দেখে না। নানারকম অবাঞ্ছিত ঝামেলা ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় বলে নারীরা দূরের কোনো জায়গায় সহজে যেতে চায় না, গেলেও কাজ পায় না। ফলে বাধ্য হয়েই কম মজুরিতে নিজ এলাকায় নারীরা কাজ করে। এটাকেই সাঁওতাল পুরুষরা নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান মজুরি বৈষম্যের সবচেয়ে বড়ো কারণ হিসেবে উল্লেখ করে। নারীদের কম মজুরি পাবার ক্ষেত্রে পুরুষদের অভিমত হচ্ছে, মেয়েরা দেরি করে কাজে যায়। কারণ তাদের দৈনন্দিন ঘরের কাজ শেষ করে কাজে যেতে হয়। এতে করে তারা ৯-১০টার আগে কাজে যেতে পারে না। কিন্তু পুরুষরা সকাল-সকাল কাজে যেতে পারে। তারা এ-ও মনে করে যে, নারীরা বেশি কাজ করতে পারে না। তাদের শরীর দুর্বল। এসব যুক্তির সঙ্গে নারীরাও একমত পোষণ করে। সাঁওতাল পুরুষদের মতে, সংসারে পুরুষ বেশি আয় করে। পক্ষান্তরে কোনো কোনো সাঁওতাল নারীর অভিমত হচ্ছে, নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি আয় করে। তবে অনেকের অভিমত হলো, সংসারে কাজ বেশি করে মেয়েরা, কিন্তু পুরুষরাই আয় বেশি করে। পুরুষদের মতে, এই আয় খরচের সিদ্ধান্ত নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে করে থাকে। অন্যদিকে নারীদের অভিমত হচ্ছে, নারীরা সংসারে আয় করলেও খরচের সিদ্ধান্ত পুরুষরাই গ্রহণ করে থাকে। হাতে গোনা দু-একটি পরিবারে নারী-পুরুষ উভয়েই খরচের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। সংসারে কী কী প্রয়োজন সে তালিকা নারীরা করে বটে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনটা কেনা হবে, কতটুকু কেনা হবে সে সিদ্ধান্ত পুরুষেরই। আর্থিক অনটনের পাশাপাশি শিক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা বা আগ্রহের অভাবকেও বড়ো প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেকে, বিশেষত নারীরা। তাদের মতে, সন্তানদের লেখাপড়া শেখালে অনেক দূর পর্যন্ত শেখাতে হবে এবং এতে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হবে? এই কারণে অনেকে সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে চায় না। তাছাড়া লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে, এমন মনোভাবের কারণেও অনেকে সন্তানকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী। শিক্ষাক্ষেত্রে এই পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেবে তারা ভাষাগত সমস্যা, অসচেতনতা, দারিদ্র্যের কারণে অল্প বয়সে উপার্জনমুখী কাজে যুক্ত হওয়া বা মাঠের কাজে যাওয়া, লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করতে না-পারা ইত্যাদিকে চিহ্নিত করলেও তাদের অনেকের মতে, লেখাপড়া না-করার পেছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ ভাষাগত সমস্যা। সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা একেবারেই কম। অনেকে বিভিন্ন সংস্থার ঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে। তারা কোনোমতে নাম স্বাক্ষর করতে শেখে। তারা নাম স্বাক্ষর করতে পারলেও লিখতে-পড়তে বা হিসাব করতে পারে না। সাঁওতাল মেয়েরা ইদানিং দু-একজন হাই স্কুলে পড়লেও স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পর্যন্ত এগোতে পারে না। ছেলে-মেয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে সাঁওতাল নারী এবং পুরুষ উভয়েই ছেলের শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারা মনে করে, ছেলেরা ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারা বড়ো হয়ে পরিবারের হাল ধরবে। বাবা-মাকে খাওয়াবে। আর মেয়েদের বিয়ে হলে পরের বাড়ি চলে যাবে। কাজেই পড়াতে হলে ছেলেদেরই পড়ানো উচিত। সাঁওতালদের অধিকার আদায়ে শিক্ষিত-সচেতন করার পাশাপাশি আইনি সহায়তা দেওয়াও খুব জরুরি। আরো জরুরি হচ্ছে সাঁওতালদের যেসব প্রথাগত আইন বা নিয়ম রয়েছে সেগুলোর সংস্কার করা। সাঁওতালদের মানবাধিকার রক্ষায় প্রথাগত আইন কল্যাণকর অংশটুকু রেখে বাকিটুকু যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। সাঁওতালসহ বিভিন্ন আদিবাসী নারীর সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার, পারিবারিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকার যদি সঠিকভাবে পালক করে, তবেই তাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে।