● ছবিতে- সাঁওতাল রমণী ও শিশুরা। সাঁওতাল পরগনা। ১৯০০ শতকের প্রথম দিকের ছবি।
(ছবি সৌজন্যে- ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ইউনাইটেড কিংডম)ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের আদিবাসী হিসেবে যাদের আখ্যায়িত করা হয, তাদের মধ্যে সাঁওতাল জাতি হল সবচাইতে সরল জীবন-যাপনকারী, অল্পেই সন্তুষ্ট একটি জাতি গোষ্ঠী। অত্যন্ত নিরীহ, শান্তিপ্রিয় আদিবাসী সাঁওতাল জাতির সাদামাটা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর যোগসাজশে স্থানীয় জমিদার, জোতদার এবং মহাজনরা প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত করেছিল। সাঁওতাল জাতির ওপর ক্রমাগত শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, দাসত্ব আর নারীর অবমাননা যখন সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করেছিল, তখনই শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা ঐক্যে পৌঁছেছিল। গড়ে তুলেছিল দুর্বার আন্দোলন। এই বিদ্রোহে প্রতিবাদী সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল প্রাণ দেয়।

সাঁওতালরা সান্তাল, সান্তালি, হোর, হর, সাঙ্তাল, সান্দাল, সন্থাল, সান্থাল, সান্তালি, সাতার প্রভৃতি অভিধায়ও অভিহিত হয়ে থাকে। বর্তমান গণনা অনুসারে সাঁওতাল জাতির মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬১ লক্ষ। এদের সিংহভাগ (প্রায় ৫৯ লক্ষ) ভারতের ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা রাজ্যে বসবাস করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ও নেপালে সাঁওতাল জাতির মানুষের বাস রয়েছে।
ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্য অনেক নৃগোষ্ঠীর মত মঙ্গোলীয় গোত্রের নয়। এরা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে যে ভাষাটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এদের মধ্যম গড়নের আকৃতির শরীর, ত্বকের গাঢ় রঙ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট এবং কোঁকড়ানো চুল তাদের অস্ট্রেশীয় নৃতাত্বিক উৎস নির্দেশ করে যে গোষ্ঠির মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল দ্রাবিড়দেরও আগে অস্ট্রেলিয়া এবং সন্নিহিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপমালা থেকে। দেহ কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সাঁওতালদেরকে বিশুদ্ধ প্রাক-দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে মনে করা হয়। তবে অস্ট্রেলীয় কৌমগুলোর সাথে সাঁওতালদের বেশ মিল লক্ষ করা যায় বলে তাদেরকে আদি অস্ট্রেলীয় বলা হয়। ধারণা করা হয় সুঁতার (Soontar) কথাটি থেকে সাঁওতাল শব্দের উদ্ভব। সুঁতার বাঙালিদের প্রদত্ত খেতাব।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে যে, আদি মানব ও মানবী পিলচু। হড়ম ও পিলচু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান থেকেই তাদের উদ্ভব। এজন্যই সাঁওতালরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত। সাঁওতালী ভাষায় এ গোত্র গুলো ‘পারিস‘ নামে অভিহিত। তাঁদের গোত্রগুলি হল-
১) হাঁসদা
২) সরেন
৩) টুডু
৪) কিসকু
৫) মুরমু
৬) মান্ডি
৭) বাস্কে
৮) বেসরা
৯) হেমরম
১০) পাউরিয়া
১১) চঁড়ে
১২) বেদেয়া
প্রথমে সাতটি গোত্র ও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে মোট বারোটি গোত্র হয়। সাঁওতালদের মধ্যে টোটেম বিশ্বাস প্রচলিত আছে। প্রতিটি গোত্র তাদের পূর্বপুরুষ কিংবা গাছপালা, জীবজন্তু ও পশুপাখী ইত্যাদি নামে পরিচিত। হাঁসদাক গোত্রের লোকের বিশ্বাস তাদের উদ্ভব ঘটেছে হাঁস থেকে। তাই হাঁসদাক গোত্রের হাঁস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। আবার সোরেন গোত্রের উৎপত্তি হরিণ থেকে তাই তাদের হরিণের মাংস খাওয়া নিষেধ।
সাঁওতালরা প্রতি মুহূর্তে সূর্যকে স্মরণ করে ‘সিংচাঁন্দো’ বা সিংবঙ্গা বলে । জাহের থান’ ও ‘মাঞ্জহি থানে’ সূর্য ও পৃথিবীর উপাসনা করা হয়। এই দুজনের উপস্থিতিতেই ফসলের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনা (ফসল সৃষ্টি) যে ধ্রুব সত্য তাঁরই প্রতিক হিসাবে উক্ত দুটি থানে ধিরি (পাথর) অতি অবশ্যই স্থাপন করা হয়। আর এই ফসল (আমন ধান) কাটার বা ওঠার পরই সহরায় অর্থাৎ সারি সহরায় উৎসব হয়।
সাঁওতালদের ধর্মের নাম ‘সারি ধরম’ কিছু কিছু ব্যক্তি আবার ‘সারনা ধরম’ও বলে থাকেন। ‘সারি’ কথার অর্থ – সত্য, আর ‘সারনা’ কথা এসেছে ‘সারিন্ (সত্য) + আঃ (তাহা) = সারিনাঃ। এই সারিনাঃ থেকে সারনা হয়েছে। একমাত্র জাহের বঙ্গা সাঁওতালরায় সুপ্রাচীনকাল থেকেই সারি ও সারনা শব্দ দুটি ব্যবহার করে আসছেন। সমার্থক শব্দ হওয়ায় জাহের বঙ্গা সাঁওতালরা ‘সারি ধরম’ ও ‘সারনা ধরম’ বলে থাকেন।
সারি বা সারনা-র অর্থ একই তা হল সত্য। ‘সারি ধরম’ মানে সত্য ধর্ম। ধর্ম গ্রন্থের নাম- ‘জমসিম বিন্তী’। সাঁওতালদের মতে সত্য ব্যতিরেকে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, তাকে আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার কে? সেই জন্যই তাদের সমাজে কোন অবতার বা ধর্ম গুরুর আবির্ভাব পরিলিক্ষত হয়নি। সৃষ্টির আদিকালে স্বয়ং ‘মারাং বুরু’ যে নির্দেশ দিয়ে গেছেন তা চিরন্তন সত্য।
সাঁওতালদের নিজস্ব একটি ধর্ম রয়েছে, যার নির্দিষ্ট কোনও নাম পাওয়া যায় নি। তবে এ ধর্ম কিছুটা হিন্দু ও কিছুটা বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রন বলে মনে হয়। তাদের মতে তাদের আদি বাসস্থান 'হিহিরি-পিপিরি' যা অনেক ঐতিহাসিকের মতে সম্ভবত ব্যাবিলন। তাদের ধর্ম বিশ্বাস মতে পৃথিবীর আদি মানব দম্পতি পিচলু হরম ও পিচলু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান পৃথিবীতে সাতটি সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে যা হাস্‌ডক বা হাস্‌দা, মুর্ম্মু, কিস্‌কু, হেমব্রম, মার্ডি বা মারানডি, মারন্ডি এবং সোরেন, সরেন সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত। পরে এই সাত সম্প্রদায় আরও পাঁচটি সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। এ সমস্ত হলো বাস্‌কে, বেসরা, পাউরিয়া, চোরে এবং বেদিয়া। এদের প্রধান আরধ্য দেবতা হলো সিংবাঙ্গো বা সূর্য। ধর্ম উৎসবে এরা নাচগান আর হাড়িয়া পান করে। কোন কোন ধর্ম উৎসব সাত দিন ধরে চলে। ধর্ম উৎসবে সাঁওতালরা দেবতার উদ্দেশ্যে সাদা মোরগ বা পাঁঠা বলি দিয়ে থাকে। কোন কোন উৎসবে এরা জোড়া পায়রাও বলি দিয়ে থাকে। পূজা পার্বণে এরা হাড়িয়া পানের পাশে পাশে শুকরের মাংস সহযোগে উৎসব করে থাকে। একই সাথে পূজা পার্বণে এরা মহুয়া ফুল ও ফলের রস দিয়ে প্রস্তুতকৃত এক ধরণের বিশেষ পানীয় পান করে থাকে। তবে প্রতিটি পূজা পার্বণে এদের শালগাছ ও ফুল অপরিহার্য। শাল গাছের অভাবে এখন তারা অনেক সময়ে বট বা আম গাছও ব্যবহার করে থাকে। এদের ধর্মীয় উৎসব গুলির মধ্যে মারাং বুরুর পূজা, বোঙ্গা পূজা, পুষণা, ফাগুয়া ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়া বাৎসরিক উৎসব হিসাবে সাঁওতাল জনগোষ্ঠি কারাম উৎসব নামে একটি উৎসব পালন করে থাকে। শিকার করা সাঁওতালদের একটা ধর্মীয় অংশ। এ কারণে বছরে অন্তত এক দিন সাঁওতাল পুরুষদের তীর ধনুক নিয়ে শিকারে বের হয়ে কুকুর, বিড়াল, উদ, ইদুর, খটাশ বা খোরগোশ কোন কিছু একটা শিকার করতেই হবে।
সাঁওতালরা জাতি হিসাবে খুব পরিচ্ছন্ন এবং সমাজবদ্ধ। এদের সমাজে একজন করে দলপতি থাকে আর তার থাকে কযেকজন সহযোগী। দলপতিদের এরা মাঝি বলে সম্বোধন করে থাকে। এই মাঝিরাই এদের বিচার-বিবাদ মীমাংসা ইত্যাদি করে থাকে। নিজেদের কোন বিবাদ বিসম্বাদ নিয়ে এরা কখনো আইন আদালতের ধারে কাছেও যায় না। মাঝিদের বিচার ব্যবস্থাই এদের কাছে দেবতার নির্দেশ।
সাঁওতাল সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তিতে পুত্রদের অধিকার সমান, কিন্তু মেয়েদের কোন অধিকার নেই। তবে পিতা ইচ্ছা করলে মেয়েকে কিছু দিয়ে যেতে পারেন। তবে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে পিতা প্রত্যেক মেয়েকে একটি করে গাভী প্রদান করে। পুত্রহীন ব্যক্তির যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা তার সহোদর ভাইয়েরা পেয়ে থাকে।
সাঁওতালদের আগে আট দশ প্রকার বিবাহ রীতির প্রচলন থাকলেও আজকাল তিন ধরনের বিবাহের প্রচলন দেখা যায়। যথা-
১) আসলি
২) রাজারাজি
৩) হুর কাটারা বা ইতুর বিবাহ
সাঁওতাল সমাজে বহিঃগোত্র বিবাহ প্রচলিত। এমনকি উপগোত্রের মধ্যেও বিবাহ হয় না। সাধারণত ছেলের বয়স ১৯ ও মেয়ের বয়স ১৫-১৬ হলে বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া নিরবোলক নামক বিয়ের প্রচলন সাঁওতাল সমাজে লক্ষণীয়।
১) আসলি বিবাহ: আসলি বিবাহ সম্ভ্রান্ত পরিবার ও শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই প্রচলিত। এ ধরনের বিবাহ কন্যার পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের সম্মতিতেই সম্পন্ন হয়।
২) রাজারাজি: রাজারাজি বিবাহ হল প্রেম করে বিবাহ। সাঁওতালদের প্রত্যেক গ্রামেই হাট বসে। বস্তুত কেনাবেচার উদ্দেশ্য হলেও সাঁওতাল যুবক যুবতীরা তাদের পছন্দমত প্রিয়জনদের সেখানে খোঁজ করে। মেয়েরা যখন হাটে যায়, তখন তাদের সাথে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি থাকে। সাঁওতালী ভাষায় তাদের যোগমাঝি বলা হয়। কোন সাঁওতাল মেয়ের যদি কোন ছেলেকে পছন্দ করে তখন সে যুবতী যোগমাঝির কাছে তা প্রকাশ করে। তারপর যোগমাঝি সে যুবককে সন্ধান করে বের করে এবং তার নিকট সব কিছু খুলে বলে। যুবকটি যদি এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন যোগমাঝি ছেলে ও মেয়ের অভিভাবকের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বিয়ের দিন ধার্য করে। এর পর 'লসমিদা' বা পাকাদেখার পর 'সুনুস-সাসান' বা তেল-হলুদের একটি অনুষ্ঠান হয়। এর পর ঘটক 'লমতা' বা বাজনাদার নিয়ে কনের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে কনের গ্রামের কাছে গিয়ে কোন একটি গাছ তলায় বাজনা বাজাতে থাকে। এ বাজনার শব্দ শুনে কনে পক্ষের লোকজন পাড়ার প্রবেশ মুখে এসে হাজির হয়। এসময় দুপক্ষের মধ্যে একটি লড়াই বাধবে যাতে কনে পক্ষের হার অনিবার্য। কোন কোন ক্ষেত্রে এ সময় বর পক্ষের লোকজন কনেকে অপহরণও করে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে এ অপহরণ অভিনয়ও হতে পারে। এর পর বেশ কিছু আচার আচরণের পর বর পক্ষের দেয়া নতুন কাপড় চোপড় পরে কনে একটি বাঁশের তৈরী বড় ডালি বা ঝুড়িতে গিয়ে বসবে। বরের ভাই সহ অন্য আত্মীয় স্বজনেরা এ সময় ওই ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে ঘুরতে শুরু করবে। এ সময় বর তার ভগ্নিপতির কাঁধে চেপে ঝুড়িতে বসা আপদমস্তক মুন্ডিত কণের সিঁথিতে শালপাতার পাত্র থেকে সিঁদুর পড়াতে পারলেই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে যায়। এর পর বর কনের পোষাকে একটি গিট বেধে দেওয়া হয় যা কনে বরের বাড়ীতে যাওয়ার আগে খোলা যাবে না। এই গিট বাধার পর কনের মা মেয়ে জামাই ও 'লমতার' পা ধুয়ে দিবে। এর পর খাওয়া দাওয়া ও হাড়িয়া উৎসব শুরু হবে যা সারা রাত চলবে। বিয়ের সময় কনের বাড়ীর উঠানটি শামিয়ানার মতো করে শালপাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সাঁওতালি বিয়েতে বরপক্ষকে মূল্য দিয়ে কনেকে কিনে নিতে হয়। অবশ্য এর দাম সাড়ে বারো টাকা কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে এককুড়ি পাঁচ টাকা মাত্র। বিয়ের পর কনেকে অবশ্যই বর পক্ষের সাথে পায়ে হেটে শ্বশুর বাড়ী যেতে হবে।
৩) হুর কাটারা: হুর কাটারা বিবাহ হচ্ছে জোর করে বিবাহ। কোন যুবক যদি কোন যুবতীকে ভালোবেসে ফেলে এবং সেই যুবতী যদি তাকে অপছন্দ করে ও বিয়েতে অসম্মতি জানায় এক্ষেত্রে যুবক তাকে পাবার জন্য হাটে যায়। সেখানে সে যুবতীর খোঁজ করতে থাকে। যুবতীর সাক্ষাৎ পেলে যুবক সুযোগ মত যদি যুবতীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিতে পারে তাহলে সে যুবতীর অন্যত্র বিয়ে হতে পারে না। সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত সংস্কার হল অবিবাহিত যুবতীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিলে সে যুবতীর আর অন্যত্র বিয়ে হতে পারে না। তার গ্রামের মাতব্বরদের মাধ্যমে যুবককে অর্থদন্ডে দন্ডিত করা হয় এবং তা আদায় হলে যুবক যুবতীর বিবাহ কার্য সমাধা করা হয়। এই ধরণের বিবাহের ক্ষেত্রে যুবতীর পছন্দ-অপছন্দ এবং সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি সবই উপেক্ষিত। এ প্রথাটি তাদের মধ্যে খুব একটা জনপ্রিয় নয়। নেহাতই ধর্মীয় ভাবে স্বীকৃত বলে আজও তারা এ প্রথাটি মেনে চলে।
আদিকাল থেকেই কৃষিকে এরা প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নারী পুরুষ সবাই জমিতে কাজ করে। পুরুষেরা হাল চাষ এবং নারীরা বীজ বোনা ও ফসল তোলার কাজ করে। সাঁওতালরা কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি নিজেরা তৈরি করে। শিকার করার ব্যাপারে এদের উৎসাহ খুব বেশি। বাংলাদেশে বন জঙ্গল কমে যাওয়ার কারণে তাদের এই পেশায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে অনেক সাঁওতাল নারী-পুরুষ কুলি, মজুর, মাটি কাটার শ্রমিক ও অন্যান্য কাজ করে।
এদের ঘরগুলো ছোট এবং মাটির তৈরি। ঘরে সাধারণত কোনো জানালা থাকে না। সাঁওতালরা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। সাঁওতাল পুরুষরা আগে সাদা থান কাপড়ের ধুতি পরতেন। বর্তমানে লুঙ্গি, ধুতি, গেঞ্জি, গামছা ব্যবহার করে। নারীরা ‘ফতা‘ নামের দুই খন্ডের কাপড় পরে থাকে। বর্তমানে 'আরা শাড়ি'ও ব্যবহার করতে দেখা যায়। পুরুষ সকলে হাতে উল্কির ছাপ দেয়। মেয়েরা রূপার তৈরি গহনা যেমন- বালা, ঝুমকা, আংটি, মল, হাঁসুলি ইত্যাদি ব্যবহার করে এবং খোঁপায় ফুল গুঁজতে ভালোবাসে। অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী সাঁওতালি সমাজে যে বিয়ে হয় তাকে সাঁওতালি ভাষায় ‘ডাঙুয়াবাপলা‘ বলে।
সাঁওতালদের কেউ মারা গেলে তাঁরা তাঁকে কবরস্থ করে। এর পর সন্ধায় বাড়ীতে মোরগ পোলাও করে বাড়ীর সকলে সহ আত্মীয় স্বজনদের খাওয়ানো হয়। এ খাবারের একটা অংশ মৃতের আত্মার খাবারের জন্য রান্নাঘরের মাঝখানে রেখে দেওয়া হয়। তাদের বিশ্বাস অনুসারে এ খাবারের কিছু অংশ অবশ্যই মৃতের আত্মা খেয়ে থাকে বলে পরের দিন ওই খাবার কিছুটা কমে যায়। মৃতের আত্মার উপস্থিতি পরীক্ষার জন্য ঘরে ছাই বিছিয়ে রাখা হয়। তাদের বিশ্বাস মতে এই ছাইয়ে মৃতের আত্নার পায়ের ছাপ দেখা যায়। খাবারের অবশিষ্ট অংশ পরদিন কুকুর ও বিড়ালকে খেতে দেওয়া হয়। এই বিশেষ রীতিটি আদিকাল থেকে এখনো সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত আছে যাকে শিক্ষিত সাঁওতালরা আদি অষ্ট্রেলিয় প্রথার অংশ হিসাবে বর্ণনা করেন।
আদি সাঁওতাল জনগোষ্ঠির পোষাক ছিল বৈচিত্রময়। পুরুষেরা পরতো লেংটি আর মেয়েদের পোষাক ছিল বিচিত্র নক্সার মোটা কাপড়ের দুখন্ড বস্ত্র। আধুনিক কালে মেয়েদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ধারায় পেচানো শাড়ি পড়তে দেখা যায়। কৃষিজীবি পুরুষেরা ধুতি-লুঙ্গি পরে থাকে। শিক্ষিতদের মধ্যে আধুনিক যুগের প্যান্ট-শার্ট পড়তে দেখা যায়।
● সাঁওতাল বিদ্রোহ: পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাংলা ও বিহারের ক্ষমতা দখল করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশে তাদের যাত্রা শুরু করার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকা দখল করতে থাকে এবং খাজনা আদায়ের নামে তারা ধন-সম্পদ অবাধ লুট করতে থাকে। রাজমহল থেকে হাজারীবাগ ও মুঙ্গেরের সীমান্ত পর্যন্ত এলাকাটি ছিল গভীর জঙ্গল। বাঘ, ভালুক, হাতি, বিষাক্ত সাপের সঙ্গে লড়াই করে সাঁওতাল, পাহাড়ি, মাল পাহাড়ি আদিবাসীরা স্মরণাতীত কাল থেকে এক জঙ্গলে বসবাস করে আসছিল। এরা কোনো অধীনতা মানতে প্রস্তুত ছিল না। ১৭৭২ সালে ক্যাপ্টেন ব্রুক একদল সৈন্য নিয়ে পাহাড়িদের দমন করতে গেলে তীরের আঘাতে অধিকাংশ সৈন্য প্রাণ হারালে ব্রুক পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
১৭৭৯ সালে অগস্টাস ক্লিভল্যান্ড ভাগলপুরের কালেক্টর নিযুক্ত হয়ে প্রান্তদেশ নামে একটি উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করলে পাহাড়িরা সেখানে যেতে রাজি হয় নি। সাঁওতালরাও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন মানতে অস্বীকার করে। কোম্পানির বশ্যতা অস্বীকার করে সাঁওতালরা জমির ওপর খাজনা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। জমির ওপর খাজনা দেওয়াকে অন্যায়-অন্যায্য বলে সাঁওতালরা চিহ্নিত করে।
ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা খাজনা আদায়ের জন্য পাহাড়িদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে, সাঁওতালদের সম্পদ লুট করে এবং তাদের ভাগলপুরে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করা শুরু করে। এতে ক্ষেপে উঠেন বাবা তিলকা মাঝি। সাঁওতালদের নিয়ে তিনি মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলে তীর, ধনুক, টাঙ্গি, বাটুল ও বর্শা চালানো শিক্ষা দিতে লাগলেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি তিলকা মাঝির বাটুলের আঘাতে প্রাণ হারাল ক্লিভল্যান্ড। ক্লিভল্যান্ডের মৃত্যুতে হিংস্র হয়ে উঠে ইংরেজরা। হাজার হাজার সৈন্য লেলিয়ে দেওয়া হয় বিদ্রোহীদের দমন করতে। কত সাঁওতাল নারী, পুরুষ, শিশু প্রাণ হারাল, কত গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, হাতি দিয়ে সাঁওতালদের ঘরবাড়ি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হলো তার কোনো হিসাব রইল না। কয়েক হাজার সাঁওতালকে হত্যা করে বিদ্রোহানল নিভিয়ে দিল ইংরেজ বাহিনী। তিলকা মাঝি ধরা পড়ল। তাকে ভাগলপুরে ধরে এনে নিদারুণভাবে চাবুক মারা হলো। ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে গোটা শহর টেনেহিঁচড়ে ঘোরানো হলো। তাতেও তার মৃত্যু না হলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তিলকা মাঝিকে হত্যা করা হয়। এভাবেই নিভে যায় অরণ্য দেশের প্রথম বিদ্রোহ।
১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আদিবাসী সাঁওতাল বিদ্রোহীরা আবার একত্র হয়। তারা ১৭৮৮-১৭৯১ পর্যন্ত তিন বছরে সেখানে এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে ইংরেজ শাসন অচল হয়ে যায়। এ সময় ইংরেজরা আবারো কৌশলের আশ্রয় নেয়। বীরভূমে জঙ্গল কেটে আদিবাসীদের বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়ে বিদ্রোহ শান্ত করে।
১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির মালিক হয় জমিদার। তারা আদিবাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে থাকে। চাষের জমি বাড়ানোর জন্য তারা সাঁওতালদের বিনা পারিশ্রমিকে খাটায়। এছাড়াও জমিদাররা মিথ্যা মামলা করে নিজপক্ষে রায় পেয়ে সাঁওতালদের জমি দখল করত। ব্যবসায়ীরা সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে দোকান খুলতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় জিনিস, রঙিন কাপড়, ধাতু ও শাঁখার গয়না বাকিতে বিক্রি করে পরে আস্তে আস্তে টাকা আদায় করত। এদিকে শস্যের দাম বেশি বেড়ে যাওয়ায় মহাজনরা সাঁওতাল গ্রামগুলোতে এসে ঘাঁটি করে। মহাজনরা চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের সুদ এবং নানা কৌশলে নিরীহ সাঁওতালদের ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। মহাজনরা তাঁদের গরু, মহিষ থেকে শুরু করে ভিটেমাটি পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল। আর সে কারণেই শুরু হয়েছিল তাঁদের মুক্তির লড়াই।
১৮০০ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্যাপকহারে নীলচাষ হলে কৃষকের ওপর চরম অত্যাচার নেমে আসে। নীলকররা চাষীদের নীল বুনতে বাধ্য করল। যদি কেউ নীল বুনতে অস্বীকার করত তাহলে তার ওপর জোর-জুলুম, মারধর করা হতো। এমনকি বিদ্রোহী চাষীদের নীলকুঠির কয়েদখানায় বন্দি করে রাখা হতো এবং নেতৃস্থানীয় কেউ হলে তাকে এক কুঠি থেকে অন্য কুঠিতে চালান করা হতো। শেষ পর্যন্ত তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
১৮৫৫ সালে ভারতের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনার সদর শহর বারহাইত থেকে আধমাইল দূরে ভাগনাডিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারের চার ভাই সিধু মুর্মু, কানু মুর্মু, চাঁদ মুর্মু, ভায়রো মুর্মু এবং দুই বোন ফুল মুর্মু ও জান মুর্মুদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সাঁওতাল গণসংগ্রাম ঐক্যবদ্ধ করেছিল নিপীড়িত আদিবাসীদের।
সিধু, কানু, ভায়রো, চাঁদ চারভাই নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। সিধু-কানু জানত আদিবাসীদের জাগিয়ে তুলতে হলে ধর্মের গান গাইতে হবে। তাই তারা প্রচার করত, তারা ঠাকুরের নির্দেশ পেয়েছে। ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন সিধু-কানু গ্রামে গ্রামে সাঁওতালদের কাছে ‘গিরা’ পাঠাল। ‘গিরা’ সাঁওতালদের কাছে ধর্মীয় আহবান, জাতির একতার ডাক। পাহাড়-পর্বত-অরণ্যব্যাপী একই সুর ওঠে ‘দোলা দোমেলা দোমেলা, দেলা লগন লগন দেলা ভগনাডিহি’ অর্থাৎ চল চল, দলে দলে চল, ভগনাডিহি চল। নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, মাঠ-ঘাট ডিঙিয়ে সাঁওতালরা তীর, ধনুক, টাঙ্গি, কুড়াল, ধামসা, মাদল, বাঁশি নিয়ে ভগনাডিহি গ্রামে সিধু-কানুর পাশে এসে দাঁড়ায়। সিধু ও কানু সাঁওতালদের আদি কাহিনী শোনায়। সেই হিহিড়ি পিপিড়ি, চায়-চম্পা, সাতভুই, শিখরভুই হাজারীবাগ হয়ে দামিন-ই-কোহতে বনবাদড়ে কেটে পাহাড় ভেঙে কেমন করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের পূর্বপুরুষরা আবাদি জমি তৈরি করেছিল এবং কেমন করে জমিদার নায়েব গোমস্তা, পুলিশ, মহাজন সাঁওতালদের জমি দখল করছে, ফসল লুট করছে, ফসলের জমিতে গরু-ঘোড়া-হাতি দিয়ে ফসল নষ্ট করছে, ঋণের জালে আবদ্ধ করে ক্রীতদাস বানিয়েছে, শান্ত-নিরীহ সাঁওতালদের জেলে পুরে নির্যাতন করে হত্যা করছে। রেলপথের সাহেবরা কীভাবে সাঁওতাল নারীর ইজ্জত নষ্ট করছে, মাঝি-মোড়লদের লাঠিপেটা করছে এ কাহিনী বর্ণনা শেষে সিধু-কানু সবাইকে বলেন, সব উৎপীড়নকারীকে উচ্ছেদ করে সাঁওতালদের স্বাধীন জীবন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের এই আহবানে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা জমিদার মহাজনদের হত্যা করে তাদের ধন-সম্পদ লুট করে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের রণশক্তি বৃদ্ধির কাজে ব্যয় করতে লাগল। নীলকুঠি ধ্বংস করে আগুন জ্বালিয়ে দিল। অনেক জমিদার-মহাজন পালিয়ে যায়। অনেকে সিধু- কানুর কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। তাদের ক্ষমা করা হয় কিন্তু হিসাবের খাতা, দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন হাজার হাজার সাঁওতাল আদিবাসী ডগনাডিহি গ্রামে উপস্থিত হয়ে শপথ গ্রহণ করেছিল যে তারা তার জমিদার, মহাজন, পুলিশ ও পাইক পেয়াদাদের অত্যাচার সহ্য করবে না। হাজার হাজার কালো মানুষের কণ্ঠ থেকে সেদিন বেরিয়ে এসেছিল ‘দেলায়া বিরিদ পে দেলায়া তিঙ্গুন পে’ অর্থাৎ ‘জাগো ওঠো, সাঁওতাল রাজ কায়েম কর।’ ভগনাডিহির মহাসভা থেকে ১৪০ মাইল দূরে তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতা অভিমুখে সিধু-কানুর নেতৃত্বে অগ্রসর হয়েছিল তাদের দাবি-দাওয়া গভর্নর জেনারেলের কাছে পেশ করার জন্য। উইলিয়াম হান্টার তাঁর এক গ্রন্থে লিখেছিলেন, ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন কলকাতার দিকে এই বিপুল অভিযান শুরু হয়। এ অভিযানে কেবল নেতাদের দেহরক্ষী বাহিনীর সংখ্যাই ছিল ত্রিশ হাজার।’
১৮৫৫ সালের ১৫ জুলাই মেজর বারোজ বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে পিয়ালপুর এসে হাজির হলেন সাঁওতাল বিদ্রোহীদের দমনে। যুদ্ধ শুরু হলো দুপুর বেলা। ইংরেজ সৈন্যদের কামান-বন্দুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির মতো তীর ছুড়তে থাকে সাঁওতালরা। ইংরেজ শাসনের সূচনালগ্নে বাংলাদেশ এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় আদিবাসীরা বহুবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞান, সঠিক নেতৃত্ব আর দূরদৃষ্টির অভাবে সব বিদ্রোহ মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রত্যেকবারই।
১৮৫৫-১৮৫৭ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহে ২৫ হাজার বিদ্রোহী মারা গেছে বলে এক ইংরেজ লেখকের ভাষ্যমতে জানা যায়, কিন্তু এ সংখ্যা নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে। শুধু অক্টোবরে বিদ্রোহেই ২০ হাজার বিদ্রোহী প্রাণ দিয়েছিল। অক্টোবর বিদ্রোহের (১৮৫৫) আগে এবং পরে সিধু-কানুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইংরেজ বাহিনী যে হারে গণহত্যা চালিয়েছে, হাজারে হাজারে নিরাপরাধ নির্বোধ সরল সোজা সাঁওতালদের গুলি করে হত্যা করেছে, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে তাতে ওই সংখ্যাটা নিতান্তই বেমানান। সভ্যতার মুখোশ পরা অসভ্য ইংরেজদের হাত থেকে সেদিন স্তন্যপায়ী শিশুও রেহাই পায়নি। কোনো ইংরেজ লেখকই এসব গণহত্যা, অন্যায়-অত্যাচারের জন্য ইংরেজদের দায়ী করেনি। তারা দেশীয় জমিদার-মহাজনদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা ভালো মানুষ সেজে থেকেছেন। বিদ্রোহে সাঁওতালরা পরাজিত হলেও এ বিদ্রোহ একেবারে বৃথা যায়নি। ইংরেজরা সাঁওতালদের জন্য সাঁওতাল পরগণা করতে বাধ্য হয়েছিল এবং সাঁওতাল পরগণা থেকে হিন্দুু ব্যবসায়ী মহাজনদের বের করে দিয়েছিল। সাঁওতালদের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজদের এ সময়েই সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিষ্টানিজমের বীজ ঢুকিয়ে আদিবাসীদের ভেতর চিরস্থায়ী বিভেদ তৈরি করে দিয়েছিল যার জন্য আজ পর্যন্ত সাঁওতালরা ১৮৫৫’র মতো একজোট হতে পারেনি।
সাঁওতালদের বিদ্রোহের সময়কালেই ঘটেছিল সিপাহী বিপ্লব, যা ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রাম। উপমহাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৪৭ এবং ১৮৫৭ সাল গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ১৯৪৭ সালে এসেছিল স্বাধীনতা, সফলতা। এক রক্তাক্ত পটভূমিতে বিভক্ত হয়েছিল ভারতবর্ষ। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের তো সবটাই ব্যর্থতা। কিন্তু ব্যর্থতার মধ্যেও তা রেখে গেছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। প্রথম শিক্ষা, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা আত্মমর্যাদাশীল প্রতিটি জাতির সর্বোচ্চ কর্তব্য, এমনকি এজন্য প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়া চলবে না। দ্বিতীয় শিক্ষা, হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্য এবং এই দুই সম্প্রদায়ের ভেতরে ঐক্য স্বাধীনতা এবং স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য।
(তথ্যসূত্র:
১- সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৬৪।
২- Traditions and Institutions of the Santhals by P.O.Bodding.
৩- The Santals by Charulal Mukherjea.)
রানা বিশ্বাসের ওয়াল থেকে নেওয়া।