সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম-ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
উপজেলার আদিবাসী সাঁওতাল পল্লী জয়পুর, মাদারপুর থেকে সহস্রাধিক সাঁওতাল নারী-পুরুষ লাল ফ্লাগ ও ফেন্টুন-ব্যানারসহ প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এই কর্মসূচিতে যোগ দেন।
বিক্ষোভ মিছিলটি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বেলা ১২টায় গোবিন্দগঞ্জের থানা মোড় এলাকায় অবস্থান নিয়ে তারা ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।
অবরোধ চলাকালে বক্তব্য রাখেন, সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্ক, সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন শেখ, অর্থ সম্পাদক হবিবর রহমান, মামলার বাদী থমাস হেমব্রম, সিপিবি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি তাজুল ইসলাম, যুব ইউনিয়নের উপজেলা সভাপতি আরিফুল ইসলাম মিজান প্রমুখ।
সমাবেশে কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাসক অভিযোগ করেন, চুড়ান্ত অভিযোগ পত্রে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এজাহারভূক্ত আসামি গোবিন্দগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, চিনিকলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল আউয়াল, গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন ফকু, সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান, উপজেলার কাটাবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক ও প্রকাশ্যে সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগকারী পুলিশ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সাঁওতাল পল্লীতে আগুন লাগানোর ফুটেজ ও ছবি প্রকাশ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশে তৎকালীন গাইবান্ধার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করেন। সেই প্রতিবেদনে ৩ পুলিশ সদস্যসহ চিনিকলের ২ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়। অথচও সম্প্রতি পিবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্টে ও আদালতে দাখিলকৃত চার্জসিটে তাদের নাম নেই। এতে প্রতিমান হয় যে, পিবিআই প্রভাবিত হয়ে এই মূল আসামিদের নাম বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন।
সাঁওতাল হত্যার মামলার বাদী থমাস হেমব্রম বলেন, পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদন ও চার্জশিট তাদের মনগড়া। এই চার্জশিটের বিরুদ্ধে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নারাজির আবেদন করবেন।
কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম এই মামলার পুনঃতদন্তসহ সাঁওতালদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সাঁওতাল হত্যাকাণ্ডের বিচার, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ক্ষতিপূরণসহ তাদের ৭দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান।
কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন শেখ বলেন, যারা এই ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে রয়েছেন, পুলিশ বাদি অপর একটি মামলায় তাদেরকেও অভিযুক্ত করে আদালতে অপর একটি চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়; অন্য এলাকার সাধারণ মানুষকেও এই চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান-পিবিআই কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ মিথ্যা চার্জশিট দাখিল করেছে। তিনি বলেন, তারা এ চার্জশিট মানেন না।
প্রসঙ্গত, সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জস্থ রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তোলে। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণের চুক্তি ভঙ্গ করে ওইসব জমি লিজ দিলে তাতে ধান-পাটসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ হয়। ফলে গত ২০১৫ সালে সাঁওতাল ও স্থানীয় কিছু বাঙ্গালী অধিগ্রহণের চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে তাদের পূর্বপুরুদের জমি ফেরত পেতে আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে গত ২০১৬ সালের ১ জুলাই ওই খামারের কিছু এলাকায় তারা চারটি বড় বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে গত ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ওই খামারের বাকী জমিতে চাষ করা আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ৯ জন পুলিশ সদস্য তীরবিদ্ধ ও চার জন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে তিন সাঁওতাল শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ মারা যান। পরবর্তীতে পুলিশ এক অভিযানে ওই বসতি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে। এইসব ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে স্বপন মুরমু বাদি হয়ে গত ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করেন। পরে ২৬ নভেম্বর থোমাস হেমরম বাদি হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুল আহম্মেদসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে আরেকটি মামলা করেন।
অপরদিকে পুলিশি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে গোবিন্দগঞ্জ থানার তৎকালীন এসআই কল্যাণ চন্দ বাদি হয়ে ৪২ জন নামিয় ও আজ্ঞাত ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
গত ২৮ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) গাইবান্ধা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনর্চাজ) সহকারি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল হাই সরকার সাঁওতাল হত্যা মামলার চুড়ান্ত অভিযোগ পত্র গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে জমা দিয়েছেন। কিন্তু তারা (ভূমি পূনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির লোকজন) এই চার্জশিট প্রত্যাখ্যান করে অন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।
অপরদিকে একই সময়ের ঘটনায় দায়িত্ব পালনকালে হামলায় পুলিশ সদস্য আহত হওয়ায় পুলিশ বাদি মামলায় একই দিন ৩৯ জন সাঁওতালকে অভিযুক্ত করে একই আদালতে আরেকটি চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক মোহাম্মদ জুলফিকার আলী ভুট্টু এই চার্জশিট দাখিল করেন।
0 Comments