কোনো জাতির ভাষা কি বর্ণমালা সেই জাতির ধারাবাহিক বিকাশ ও বিরাজমানতার সঙ্গেই জড়িত। বাংলাদেশে আদিবাসী সমাজে মাতৃভাষার চর্চা থাকলেও অধিকাংশ ভাষার নিজস্ব লিপি না থাকায় অনেকেই বাংলা হরফ ব্যবহার করেই ভাষাচর্চা চালিয়ে আসছেন। চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, মৈতৈ মণিপুরিরা নিজস্ব বর্ণমালায় নিজেদের ভেতর কিছুটা মাতৃভাষার চর্চা করেন। মান্দিদের আচিক ভাষার প্রায় পাঁচ ধরনের ‘আচিক থোকবিরিম (বর্ণমালা)’ প্রস্তাবিত হলেও তা চালু নয়। লেঙ্গাম ভাষার একটি বর্ণমালাও তৈরি করেছেন নেত্রকোনার কলমাকান্দার সুরেশ নংমিন। মেনলে ম্রো উদ্ভাবিত বর্ণমালা দিয়ে ম্রো আদিবাসীদের ক্রামা ধর্মাবলম্বীরা কিছুটা চর্চা করছেন। খাসি, বম, লুসাই, মাহালি, মান্দিদের ভেতর রোমান হরফে নিজস্ব ভাষায় খ্রিষ্টধর্মের কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে সম্পূর্ণ চাকমা ভাষা ও বর্ণমালায় প্রকাশিত হয় দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস ফেবো। রাজশাহীতে শুরু হয় সাঁওতালি ভাষার প্রথম বেসরকারি বিদ্যালয়।
ভারতে সাঁওতালি ভাষা ও অলচিকি বর্ণমালার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিললেও বাংলাদেশে এখনো আদিবাসী জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতিই মেলেনি। সাঁওতালি ভাষা কোন্ লিপি বা হরফে লেখা হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশে আবারও বিচ্ছিন্ন কিছু প্রশ্ন উঠেছে। অলচিকি, রোমান না বাংলা? বাংলাদিশোম সান্তাল বাইসি, আদিবাসী মুক্তি মোর্চা, সান্তাল ল্যাংগুয়েজ ডেভেলপমেন্ট কমিটি ও মাহালে ল্যাংগুয়েজ ডেভেলপমেন্ট কমিটি সম্প্রতি রাজশাহী ও দিনাজপুরে কর্মশালা ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দাবি তুলেছে (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩.১২.২০১২)। বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত সাঁওতাল সম্প্রদায় সাঁওতালি ভাষা রোমান হরফে লেখার পক্ষে নয়।
পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু কেবল অলচিকি আবিষ্কার নয়, সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য সূচনা করেন এক সংগ্রামী অধ্যায়। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আদিবাসী সোসিও-এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাসোসিয়েন’ বা অ্যাসেকা। ১৯৭০-৭১ সালে রোমান লিপিতে সাঁওতালি ভাষা লেখার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অ্যাসেকা কলকাতায় হাজার হাজার সাঁওতাল জনগণের মিছিল সংগঠিত করেন। ১৯৭৯ সালে ভারতে সাঁওতালি ভাষার একমাত্র লিপি হিসেবে অলচিকিকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৮০-৯০ দশকে অলচিকি বর্ণমালায় প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজ শুরু হয়। ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে সাঁওতালি ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ২০০০ সালের ১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
বাংলাদেশে যারা রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষা লেখার দাবি তুলেছেন, তা নতুন নয়। নিপীড়িতের ভাষা ও বর্ণমালার ওপর অধিপতি ক্ষমতা বারবার যেমন চেপে বসে, এটি তারই সাম্প্রতিক ধারাবাহিকতা। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে অনেক খ্রিষ্টান মিশনারিদের কাজেও এই বর্ণ-বলপ্রয়োগ দেখতে পাই। রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষা লেখার ব্যাকরণ ও উচ্চারণগত জটিলতা এবং সীমাবদ্ধতাও প্রমাণিত হয়েছে। রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষার স্বরধ্বনিগুলো ঠিকমতো লেখা যায় না (সূত্র: হেরাল্ড, গোয়া, ভারত, ২২/৯/১২)। সাঁওতালি ভাষার ব্যাকরণে চারটি অবদমিত ধ্বনি আছে। মিশনারি পণ্ডিত রেভারেন্ড স্ক্রেফসরুড ও পি. ও. বোডিং এ ধ্বনিগুলোকে অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনির অবদমিত রূপ মনে করে, এগুলোকে যথাক্রমে রোমান হরফের ‘কে’, ‘সি’, ‘টি’ এবং ‘পি’ চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশ করেন। কিন্তু ফাদার হফম্যানের মতে, এই ধ্বনিগুলো ঘোষ ধ্বনির অবদমিত রূপ। তিনি এ ধ্বনিগুলোকে ঘোষ বর্ণ যথাক্রমে স্বর অবদমিত, জ্, দ্, এবং ব্ এর অবদমিত ধ্বনি হিসেবে যথাক্রমে স্বর-অবদমন ‘ডি’, ‘জে’ এবং ‘বি’ চিহ্নের সাহায্যে লেখার প্রস্তাব দেন। মিশনারি পণ্ডিতদের এই বিতর্ক ১৯২৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় (সূত্র: রঘুনাথ মুরমু: সাঁওতালি সাহিত্য ও অলচিকি আন্দোলন, ড. শান্তি সিংহ, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৩৬)। ১৯২৫ সালেই পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু অলচিকি নামে সাঁওতালি বর্ণমালা উদ্ভাবন করে এসব বিতর্ক ও সমস্যার বৈজ্ঞানিক নজির হাজির করেন।
ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে যে সাঁওতাল জনগণ ১৮৫৫ সালে সংগঠিত করেছেন দুনিয়া কাঁপানো বিদ্রোহ, ১৫৭ বছর পর সেই জনগণের পক্ষে নিজ মাতৃভাষাকে রোমান হরফে লেখা কি সম্ভব? তা ছাড়া সাঁওতালি ভাষা যখন রোমান হরফে লেখা হচ্ছে তখন এটির বেশ কিছু বর্ণের পরিবর্তন ঘটছে। রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষা শেখার মানে তাই কোনোভাবেই রোমান লিপি শেখা হয়ে যাচ্ছে না। আজকের করপোরেট দুনিয়ার বাস্তবতায় যদি ইংরেজি কি অন্যান্য ভাষা জানতেই হয়, তবে সেটি সাঁওতাল শিশুদের জন্য রাষ্ট্রই নিশ্চিত করবে। কিন্তু নিজ মাতৃভাষা নিজ ভাষায় বা জনগণের নিজস্ব সিদ্ধান্তে গৃহীত হরফের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। সামাজিক রূপান্তরের ধারাবাহিকতাই ঠিক করবে কোনো ভাষা কী হরফ কী আদলে টিকে থাকবে। দুনিয়ার সব হরফেরই একটি রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। অলচিকি হরফে বাংলাদেশের সাঁওতাল জনগণ অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, অধিকাংশেরই বর্ণ অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলায়। কৃষক, দিনমজুর থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী কি চাকরিজীবী—সবাই নিজ জাতির বাইরে বাংলা ভাষাতেই নিত্যদিনের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। রপ্ত করেছেন বাংলা বর্ণমালা। বাংলা হরফে সাঁওতালি সাহিত্য চর্চা করছেন অনেকেই। বাংলা ভাষাও কখনো কখনো সাঁওতালি ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তার করলেও নিজ দেশের গরিষ্ঠ ভাগ জনগণের প্রচলিত এই বাংলা বর্ণমালাই চাইছেন অধিকাংশ সাঁওতাল জনগণ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব বাংলা হরফের সঙ্গে সাঁওতাল জনগণের এই ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ও বিকাশমানতা স্বীকৃতি দেওয়া।
স্মরণে রাখা জরুরি, বাংলা ভাষার জন্য কেবল বাঙালি নয়, দেশের আদিবাসী জনগণেরও রক্ত-ঘাম ঝরেছে। সাঁওতালি ভাষার অজস্র শব্দ ও ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজার বছর ধরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষা। কেবল বাংলা নয়, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ শহীদ হয়েছেন সুদেষ্ণা সিংহ। সাঁওতালি ভাষা ও অলচিকি বর্ণমালার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য ভারতে সংগঠিত হয়েছে দীর্ঘ গণসংগ্রাম। আসন্ন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগেই আশা করি, সরকার সাঁওতালি ভাষাসহ দেশের সব আদিবাসী জনগণের মাতৃভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করবে। রোমান বা অন্য কোনো অপরিচিত হরফ নয়, অলচিকি না হলে বাংলা বর্ণমালার মাধ্যমেই নিশ্চিত হোক সাঁওতালি ভাষার ন্যায়বিচার।