বিগত ৯-১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন সুদূর নরওয়ের রেভারেন্ড তরবিজন লিড। দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় এ দেশে ব্যয় করেছেন মিশনারি হিসেবে, অনর্গল সাঁওতালী ভাষায় কথা বলেন। সাঁওতালী ভাষার ব্যাকরণ জ্ঞানও রয়েছে তার টনটনে। তার সাথে যখন কোনো সাঁওতাল ব্যক্তি কথা বলে ভাষার সৌন্দর্যবোধ, সঠিক ব্যবহার কিংবা স্পষ্টতা না হলে তিনি আমাদের শুধরে দেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই ভিনদেশী মিশনারি কয়েক বছর থেকে স্বদেশেই বসবাস করছেন। তারপরও বছরে কমপক্ষে দু’বার বাংলাদেশে এসে আদিবাসী সাঁওতালদের ধর্মীয় জীবন, ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত তিনি আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন- তোমরা নিজ নিজ মাতৃভাষাকে চর্চা কর; অধিকন্তু তোমরা দু’একটি ভাষাও রপ্ত করে নিতে পার। মাতৃভাষার প্রতি টান, আগ্রহ ও প্রেম না থাকলে এটি সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। রেভা লিড নিজেকে দিয়েই বলছেন- দেখ আমাকে, আমি তোমাদের সাঁওতালী ভাষা, নরওয়েজিয়ান ভাষা, ইংরেজি ভাষা বলতে পারি। এছাড়াও স্পেনিশ ভাষাও থোড়া থোড়া বুঝতে পারি। বাংলাদেশের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কয়েক ধরনের অভিধান, গ্রামার, গানের বই, গল্প-সাহিত্যের বইসহ ইতিহাস, প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকগুলো সরবরাহ করে চলেছেন নরওয়ে, ভারত, নেপাল থেকে সংগ্রহ করে।
উল্লেখ্য, নরওয়ের রাজধানী অসলোতে আদিবাসী সাঁওতালদের সংগৃহীত সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নরওয়েজিয়ানরা সাঁওতালদের নিয়ে সর্বাধিক কাজ করেছেন বাংলাদেশ-ভারত- নেপালের বিভিন্ন প্রান্তে। সাঁওতালী ভাষার ধারক-বাহক রেভারে- তরবিজন লিডের প্রচেষ্টা সফল হোক এটিই কামনা করি।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ম্রো ভাষার শব্দ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয় এমন প্রায় তিন হাজার ম্রো শব্দের পাশাপাশি বাংলা-ইংরেজি তরজমা সংকলন প্রকাশ করেছেন ইয়াঙ্গান ম্রো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচ্য ভাষা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়া ইয়াঙ্গান ম্রো এ সংকলনের কাজ শুরু করেছিলেন ১০ বছর পূর্বে। ইয়াঙ্গান জানিয়েছেন, ১০ বছর আগে তিনি চিম্বুক পাহাড়ের দুর্গম একটি পাড়ায় গিয়েছিলেন। সেদিন পাড়ায় তিন মাস ধরে অসুস্থ এক ম্রো তরুণ মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এ তরুণের বাবা বিলাপ করছিলেন। সেটা তার কানে বাজে এখনও। ওই বাবা বলছিলেন, নিজের মৃত্যু না হয়ে ছেলের মৃত্যু হলো কেন! এখন তিনি কী নিয়ে বাঁচবেন? সন্তান হারানো ওই লোকের কাছে ইয়াঙ্গুন জানতে চেয়েছিলেন, ছেলেকে হাসপাতালে কেন নিয়ে যাননি? ওই বাবার জবাব ছিল, তারা কেউই বাংলা জানেন না। এজন্য হাসাপাতালে নিতে পারেননি। ইয়াঙ্গান সেদিনই বুঝতে পারলেন, ভাষা জানা থাকলে হয়তো এভাবে মরতে হতো না ওই তরুণকে। সে বছর থেকেই তিনি শুরু করলেন ব্যবহারিক ম্রো শব্দের সংকলন তৈরির কাজ। বান্দরবানে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মারমাদের পরই দ্বিতীয় সংখ্যাগোষ্ঠী ম্রোরা। জেলায় প্রায় ৪০ হাজার ম্রো আদিবাসীর বাস কিন্তু শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সবচেয়ে অনগ্রসরই তারা। ইয়াঙ্গুন মাতৃভাষাকে, প্রতিবেশীর ভাষাকে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ভাষাকে জীবন বাঁচানোর হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। মানুষকে বাঁচানোর মধ্যে দিয়েই ভাষাকে রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট রয়েছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ খ্রিস্টাব্দে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছিলেন। জেনেছি- ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’র ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- পৃথিবীর বৃহৎ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। অর্থাৎ আমার মাতৃভূমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার দায়িত্বও সর্বাগ্রেই রয়েছে। সরকার প্রধান ২০১০ খ্রিস্টাব্দেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন-২০১০ মহান জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস করে। ইতোমধ্যেই ইন্সটিটিউট মাতৃভাষার চর্চা, সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনার সফলতা এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সরকারের সহযোগিতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর ক্যাটাগরি-২ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করেছে। এটি নিশ্চয়ই আমাদের জন্য উৎসাহব্যাঞ্জক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের ক্ষমতা ও দায়িত্বগুলো পুনর্বার উল্লেখ করছিÑ
দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ;
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এতদসংক্রান্ত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা;
বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা-আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেস্কোর সদস্য দেশসমূহের মধ্যে এ সংশ্লিষ্ট ইতিহাস প্রচার;
বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ;
বাংলা ভাষার উন্নয়নে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা;
ভাষা ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ;
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন;
ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণ;
বিভিন্ন ভাষা বিষয়ে অভিধান বা কোষগ্রন্থ প্রকাশ এবং হালনাগাদকরণ;
পৃথিবীর সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার লেখ্যরূপ প্রবর্তন;
বাংলাসহ পৃথিবীর সকল ভাষার বিবর্তন বিষয়ক গবেষণা;
ভাষা বিষয়ে গবেষণা-জার্নাল প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন;
ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশি ও বিদেশিদের ফেলোশিপ প্রদান;
ভাষা ও ভাষাবিষয়ক গবেষণায় অবদানের জন্য দেশি ও বিদেশিদের পদক ও সম্মাননা প্রদান;
ভাষা বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান;
ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের সহিত যোগাযোগ স্থাপন ও রক্ষা;
সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষে, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোন রাষ্ট্র, কোন দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সহিত চুক্তি স্বাক্ষর;
বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণমালার জন্য একটি আর্কাইভ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা;
ভাষা বিষয়ে একটি জাদুঘর নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা;
আন্তর্জাতিক মানের লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা;
ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া চ্যানেল স্থাপন;
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস, নমুনা ও তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন;
এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার কর্তৃক সময় সময় প্রদত্ত অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করা।
ভাষা শহীদের দেশে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউ, বাংলা একাডেমি কেন আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে কার্যক্রম বা উদ্যোগ নিয়ে চলেছেন! এটির ব্যাপকতা সর্বস্তরে বাড়াতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ, পরিদর্শন এবং যাতায়াত করে যে উপলব্ধিটি এসেছে, বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও জানেন না বাংলাদেশে আদিবাসীরা বসবাস করেন! জানেন না সাঁওতাল, উঁরাও, খাসি, ত্রিপুরা কিংবা মাহালী মানে কী? তারা দেখতে কেমন? মানুষ-ই চেনেনা, সেক্ষেত্রে ভাষা-বর্ণমালার চিন্তাটি অবান্তর। প্রয়োজন প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসক, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, শিল্পকলা একাডেমি, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কিংবা প্রেসক্লাবগুলোতে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসীদের মাতৃভাষার পরিচিতি, সেই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা তুলে ধরা। সর্বোপরি স্থানীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও যেন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারেন।
আদিবাসী সাঁওতালরা কয়েক বছর থেকে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, উঁরাওদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক সম্ভবপর হলেও সাঁওতালদের ক্ষেত্রে বর্ণমালা বির্তককে সামনে রেখে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের কিছু কর্মকর্তা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশের মতামতকে উপক্ষো করে পাঠ্যপুস্তকের অগ্রগতিকে রহিতকরণের প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন। আমরা মনে করি, এটি সরকারের সঠিক পদ্ধতি কিংবা নীতির বিপরীত চিন্তা-চেতনা। একটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে নিজস্ব চেতনায় উদ্ভাসিতের সুযোগ করে দেয়া উচিত, এতে বাধা দিলে হিতে বিপরীতই হয়ে থাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিশ্বে অনেক মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিকারে বাংলাদেশ করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। সারা বিশ্বের মাতৃভাষা সেখানে সংরক্ষণ হবে, সেসব ভাষা নিয়ে গবেষণা হবে।’ প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ ফেব্রুয়ারি ও ভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে। ভাষা দিবস মানেই একুশে ফেব্রুয়ারি আর একুশ মানে মাথানত না করা। ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সংরক্ষণে অপসংস্কৃতির কাছে মাথা নোয়ানো যাবে না। প্রার্থনা করি, প্রতিটি মাতৃভাষা যেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারে।